EMail: corporatenews100@gmail.com
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধের সূচনা হলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে তেলের দাম ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। বিশেষ করে, ইসরায়েল-ইরান সংঘাত যদি আরও তীব্র হয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহে বিশাল অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, যা দাম বৃদ্ধির দিকে ঠেলে দিতে পারে। যদিও তেলের দামে উত্থান কিছুদিন আগে শুরু হয়েছে, যুদ্ধের উত্তেজনা আরও বাড়লে তা আরও তীব্র হতে পারে।
গত সপ্তাহে গাজার যুদ্ধ শুরুর এক বছর পূর্তিতে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০ শতাংশ বেড়ে ৭৮ ডলারে পৌঁছেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি কি ১০০ ডলার বা তারও ওপরে তেল পৌঁছাবে? এর উত্তর অনেকটাই নির্ভর করছে ইসরায়েল এবং ইরানের প্রতিক্রিয়ার ওপর।
১. ইসরায়েলের সম্ভাব্য পদক্ষেপ
ইসরায়েল যদি ইরানের জ্বালানি অবকাঠামো, বিশেষত তেলক্ষেত্র ও পরিশোধনাগারে হামলা চালায়, তাহলে তেলের সরবরাহ বিপর্যস্ত হতে পারে। ইরানের **আবাদান রিফাইনারি** এবং **পারস্য উপসাগরের খার্গ দ্বীপে অবস্থিত তেল টার্মিনাল**—এই দুটি জায়গা মূলত ইরানের জ্বালানি রপ্তানির প্রধান পথ। এগুলিতে হামলা হলে সরবরাহ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়াতে পারে।
এছাড়া, ইরান যদি **হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়**, যেখানে বিশ্ববাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল পরিবহন হয়, তাহলে সরবরাহে বিপর্যয় ঘটতে পারে। তবে, এমন পদক্ষেপ ইরানের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে, কারণ এটি তাদের নিজস্ব রপ্তানির পাশাপাশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমদানিও বন্ধ করে দিতে পারে।
২. ইরানের প্রতিক্রিয়া
ইরান যদি এর বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানে এবং তার তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে বাজারে সরবরাহ সংকট আরও প্রকট হতে পারে। গত মাসে ইরান প্রতিদিন **২০ লাখ ব্যারেল তেল** রপ্তানি করেছে, যা বিশ্ব বাজারের ২ শতাংশ। যদি এই রপ্তানি বন্ধ হয়, তবে ওপেক প্লাসের সদস্য দেশগুলো—বিশেষত সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত—তাদের উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে। তবে, এই উপায়ও কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে।
৩. পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
যদি তেলের দাম খুব দ্রুত বেড়ে যায়, তাহলে এর প্রভাব শুধুমাত্র তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও এর প্রভাব অনুভব করবে। বিশেষ করে, **যুক্তরাষ্ট্র**—যেখানে নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে—তাদের ভোটাররা দাম বৃদ্ধিতে অসন্তুষ্ট হতে পারে। পাশাপাশি, **চীন**ও ক্ষুদ্ধ হতে পারে, কারণ চীন ইরানের প্রধান তেল ক্রেতা এবং হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তাদের রপ্তানিতে সমস্যা হতে পারে।
৪. ওপেক প্লাসের অবস্থান
ওপেক প্লাস, যা তেল উৎপাদক দেশগুলোর একটি জোট, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা যথেষ্ট হলেও এই ধরনের উত্তেজনায় সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হতে পারে। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই তাদের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, কিন্তু তা বাজারের দামের ওপর কোনো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে কি না, তা বলা মুশকিল।
৫. ভবিষ্যতের দৃষ্টি
বিশ্বব্যাপী তেলের চাহিদা মহামারির পর বেড়েছিল, কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর থেকে সেই পুনরুদ্ধার শ্লথ হয়ে গেছে। চলমান সংকটের মধ্যে, তেলের দামের বৃদ্ধি সাময়িক হতে পারে, কারণ সরবরাহের পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে। তবে যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এর প্রভাব বিস্তৃত হয়, তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়াতে পারে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে।
৬. বিশ্লেষকদের মতামত
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১৩০ ডলারে পৌঁছলেও, চাহিদার পতন ঘটাতে এটি যথেষ্ট হবে না। কারণ ইউরোপ, আমেরিকা, ও চীন—বিশ্বের প্রধান অর্থনীতি গুলোর প্রবৃদ্ধি মন্থর, এবং তারা জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে বৈদ্যুতিক গাড়ির দিকে মনোনিবেশ করছে। এমন পরিস্থিতিতে দাম বৃদ্ধির পরেও তেলের চাহিদায় দীর্ঘস্থায়ী কোনো উত্থান দেখা নাও হতে পারে।
তেলের দাম কতটা বাড়বে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে ইসরায়েল ও ইরান কি ধরনের পদক্ষেপ নেয় তার ওপর। ইসরায়েল যদি ইরানের তেল অবকাঠামোতে আঘাত হানে, তাহলে তা দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে, তবে বিশ্ববাজারের অন্যান্য শক্তি সরবরাহ বজায় রাখতে সক্ষম হবে। যুদ্ধের পরিস্থিতি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়াতে পারে। তবে, বিশ্ববাজারে সরবরাহ বাড়ানোর শক্তি রাখার কারণে দাম এই অবস্থানে স্থায়ীভাবে পৌঁছাবে কিনা তা বলা মুশকিল।